দেশ যখন উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিও জোরদার হচ্ছে, সেখানে নারী ও তরুণীরা প্রকাশ্যে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক বাস্তবতাকেই সামনে আনে। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে জনসভার দিনে বুধবার রাজধানীর বাংলামটর, শাহবাগ, কাকরাইল, চারুকলা, খামারবাড়ি, কলাবাগানসহ বেশ কয়েকটি স্থানে পথ চলতি নারীরা বিরূপ অভিজ্ঞতা ও যৌন হয়রানির শিকার হন। বাংলামটরে একদল যুবকের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া রাজধানীর একটি কলেজের তরুণী এক শিক্ষার্থী ঘটনাটি ফেসবুকে পোস্ট দেন। পোস্টটি তিন ঘণ্টায় ৫ হাজার শেয়ার ছাড়িয়ে যায়। ভুক্তভোগী অন্য নারীরাও নির্যাতনের আংশিক বর্ণনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন বলেও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নারী নির্যাতন শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও নারী নিগ্রহের ঘটনা ক্রমেই যেন বাড়ছে। এ পরিস্থিতি শুধু পরিতাপেরই নয়, উদ্বেগেরও।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, রাজধানীর বাংলামটরে শিক্ষার্থীকে হয়রানির ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। অপরাধী যে দলেরই হোক, ছাড় দেয়া হবে না। বাংলামটরে নিগ্রহের শিকার ওই তরুণী ফেসবুকে লিখেছেন, ১৫-২০ জন যুবক তাকে যৌন নিপীড়ন শুরু করলে এক পুলিশ সদস্য তাকে উদ্ধার করে একটি বাসে তুলে দেন। আমরা মনে করি, পুলিশের কড়া পাহারা থাকা সত্ত্বেও নারী নিগ্রহের ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, নারীরা আসলে কোথাও নিরাপদ নয়। প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত জনতার সামনে যখন একজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন, তখন নিজেদের সভ্য ভাবতেও লজ্জাবোধ হয়। নারীরা দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সর্বস্তরে অবদান রেখে চলেছেন, সরকার এবং প্রশাসনের উচ্চপর্যায়েও নারীরা, তখন এমন একটি দেশে নারীরা কেন নিরাপত্তাহীন- সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন অযৌক্তিক হতে পারে না। সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর সাফল্য লক্ষ্যণীয় হলেও সমাজে নারী নির্যাতন কেন থামছে না- বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবা দরকার। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। এগুলো দূর করা গেলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসত বলেও তারা মন্তব্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে আর এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। তথ্য মতে, ২০১৭ সালে উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ পাঁচ হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এক হাজার ২৫১টি ধর্ষণ ও ২২৪টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফলে নারী নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও বিছিন্ন ঘটনা হতে পারে না। পরিবার ও সমাজে নারীর ভূমিকা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অথচ নারীর জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা বঞ্চনা ও অবহেলার কাহিনী। হোক সে শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে কিংবা গ্রামের মুক্ত আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা নারী, হোক সে কর্মজীবী কিংবা গৃহিণী, হোক সে ধনী কিংবা দরিদ্র পরিবারের- প্রত্যেক নারীর জীবন কাহিনীগুলো অনেকটা একই ধরনের। আমরা মনে করি, দেশের সমৃদ্ধির স্বার্থে নারীকে এসব বঞ্চনা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে। নারীরা ঘরে কিংবা বাইরে নিরাপত্তাহীন হলে সে সমাজ অসুস্থতার পরিচয় বহন করে। ফলে অসুস্থ এই সমাজের ইতি ঘটাতে সংশ্লিষ্টদেরই নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। সর্বোপরি বলতে চাই, বুধবারের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ যেহেতু প্রশাসনের কাছে আছে, সেহেতু প্রত্যাশা করব, দায়ীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি আর যেন একজন নারীও নিগ্রহের শিকার না হন তার জন্য নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে,
নারী নিরাপত্তাহীন হলে ধীরে ধীরে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। আর এরূপ সমাজ প্রত্যাশিত হতে পারে না।